প্রশাসনের কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে যুগ্মসচিব পর্যায়ে ল্যাটারাল এন্ট্রি বা পার্শ্ব নিয়োগ দেওয়ার চিন্তা করছে সরকার।
এ বিষয়ে তিন সচিব ও একজন অতিরিক্ত সচিবের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি কয়েক দফা বৈঠক করেছে এবং তারা প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার কাজ করছে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পর এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই উদ্যোগে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে প্রশাসনের তরুণ কর্মকর্তাদের মধ্যে, তবে এ বিষয়ে কেউ প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি নন।
এর আগে গত ৫ ফেব্রুয়ারির প্রতিবেদনে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন যুগ্মসচিব ও তার ঊর্ধ্বতন পদে সরাসরি নিয়োগ চালুর সুপারিশ করেছে।
তবে কত শতাংশ পদ এভাবে পূরণ করা হবে প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করা হয়নি।
ল্যাটারাল এন্ট্রি বা সরাসরি নিয়োগ বলতে বোঝায়, প্রচলিত প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে থেকে পেশাদারদের নিয়োগ দেওয়া। যেমন: বেসরকারি খাত, শিক্ষাঙ্গন, সশস্ত্র বাহিনী, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বা অন্যান্য বিশেষায়িত ক্ষেত্র থেকে পরীক্ষিত দক্ষ ব্যক্তিদের এমন নিয়োগ দেওয়া হয়, যারা প্রচলিত নিয়োগ ও পদোন্নতির ধাপ অতিক্রম না করেও সরাসরি যোগ দিতে পারেন।
বিষয়টি নিয়ে কাজ করা কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এএসএম সালেহ আহমেদ। এতে আরও রয়েছেন অর্থ সচিব, স্থানীয় সরকার সচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব।
সালেহ আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা একাধিক বৈঠক করেছি। এখন প্রতিবেদনের খসড়া থেকে চূড়ান্ত করার কাজ হচ্ছে। শিগগির জমা দিয়ে দিব।'
বর্তমানে প্রশাসনে এক হাজারের বেশি যুগ্মসচিব রয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, সরকার যদি ১০ শতাংশ ল্যাটারাল এন্ট্রিও অনুমোদন করে, তাহলে ১০০ জনের বেশি কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হবে।
কমিটির কাজ সম্পর্কে অবগত সূত্রগুলো দ্য ডেইলি স্টারকে জানায়, পাকিস্তান, ভারত ও শ্রীলঙ্কায় ল্যাটারাল নিয়োগের বিষয়টি পর্যালোচনা করা হয়েছে। তবে দেখা গেছে, সেসব দেশে এ ধরনের নিয়োগকে সবাই সাদরে গ্রহণ করেনি।
একটি সূত্র জানায়, 'আমরা প্রশাসনে ল্যাটারাল নিয়োগের সুফল ও কুফল তুলে ধরব, তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সরকারের।'
অন্য এক সূত্র বলেন, 'ল্যাটারাল নিয়োগ প্রশাসনের চলমান সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। তারপরও সরকার যেহেতু চেয়েছে, আমরা প্রতিবেদন প্রস্তুত করছি।'
তিনি আরও বলেন, দেশের শীর্ষ মেধাবীরা প্রশাসনে যোগ দেওয়ার পর কেন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন বা প্রয়োজনের সময় তাদের সক্ষমতা দেখাতে ব্যর্থ হন—এ বিষয়টিও বোঝা জরুরি।
কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, যুগ্ম বা উপসচিব পর্যায়ে হঠাৎ নিয়োগ দিলে একই পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ ও দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে।
পদোন্নতির প্রত্যাশায় থাকা কর্মকর্তারাও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন। ল্যাটারাল নিয়োগের ফলে জুনিয়র কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সুযোগ কমে যেতে পারে। এতে করে প্রশাসনে অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে।
এ বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলা শীর্ষ কর্মকর্তারা মনে করেন, যদি যোগ্য কর্মকর্তাদের মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করে নিরপেক্ষভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে বর্তমান জনবল দিয়েই প্রত্যাশিত প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব।
বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি ১০ শতাংশ পদে বিশেষ নিয়োগ দিতে পারেন এবং এই নিয়মের আওতায় ইতোমধ্যেই সাবেক সিভিল-মিলিটারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এটি 'প্রেসিডেন্টস কোটা' নামে পরিচিত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক যুগ্মসচিব বলেন, 'কিছু সিনিয়র কর্মকর্তার দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণে প্রশাসনে নজিরবিহীন অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। আশঙ্কা করছি, ল্যাটারাল নিয়োগ পদ্ধতি ব্যবহার করে ক্ষমতাবানদের আত্মীয়-স্বজনকে প্রশাসনে আনা হতে পারে। সেটা হলে গতিহীন প্রশাসন আরও দুর্বল হবে।'
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, তাদের জানা মতে ল্যাটারাল নিয়োগপ্রাপ্তদের মাত্র তিন মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রশাসনে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, এমন চিন্তা আছে সরকারের মধ্যে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক অতিরিক্ত সচিব বলেন, 'যুগ্মসচিবরা ২০ বছরের অভিজ্ঞতার পর পদোন্নতি পান। মাত্র তিন মাসের প্রশিক্ষণে ল্যাটারাল নিয়োগপ্রাপ্তরা কীভাবে তাদের চেয়ে ভালো কাজ করবেন?'
তিনি বলেন, 'তাদের উচিত যোগ্য কর্মকর্তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা। একইসঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে, অসাধু কর্মকর্তারা যেন অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ ভোগ করতে না পারেন। তাহলেই প্রশাসন সঠিক পথে এগোবে। বিশেষজ্ঞদের দিয়ে গবেষণা হয়, প্রশাসন চলতে পারে না।'
কর্মকর্তারা আরও বলেন, কারিগরি পদে ল্যাটারাল নিয়োগে তাদের আপত্তি নেই। যেমন: নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিশেষজ্ঞদের আনা যেতে পারে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক বা প্রকৌশলী পদে।
অন্য এক যুগ্মসচিব বলেন, সরকার যাতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সতর্কতার সঙ্গে দুর্নীতির সুযোগ ও রাজনীতিকরণের মতো বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়।
তিনি বলেন, 'এখন যে প্রক্রিয়া আছে, সেই প্রক্রিয়ায় প্রশাসনে যারা যোগ দেন, তারা স্বচ্ছ ও ঘুষমুক্ত ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই আসেন। তারপরও তাদের অনেকেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ল্যাটারাল এন্ট্রি ব্যবস্থা হলে দুর্নীতি ও রাজনীতিকরণের সীমাহীন সুযোগ তৈরি হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'এমন হলে তো বহিরাগতরা প্রশাসনিক কর্তৃত্ব ভোগ করার সুযোগ পাবে। আর যারা পেশাগত আমলা, তাদের পদোন্নতি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কমে যাবে।'
সাবেক সচিব আব্দুল আউয়াল মজুমদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, বদলি ও পদোন্নতিতে সরকার ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি। তাই, ল্যাটারাল নিয়োগ দিলে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে, এমন সম্ভাবনা খুবই কম।
অনেকেই আমেরিকার 'স্পয়েলস সিস্টেম'র উদাহরণ দেন। তবে আব্দুল আওয়াল মজুমদার উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন আর সেই ব্যবস্থা অনুসরণ করে না।
অবশ্য, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানান। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রশাসনে ল্যাটারাল এন্ট্রি চালুর উদ্যোগটি খুবই ভালো। অন্ততপক্ষে এটা পরীক্ষা করে দেখা উচিত।'
তিনি আরও বলেন, 'তবে আমার মনে হয় না বর্তমান কর্মকর্তারা এটা মেনে নেবেন। তারা নিজেদেরকে মনে করেন অভিজাত মেধাবী। যদিও তাদের কর্মদক্ষতায় সেটা প্রতিফলিত হয় না।'
ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, পাকিস্তানে আগে ল্যাটারাল এন্ট্রির বিধান ছিল। তবে এখন আর সেটা কার্যকর নেই।
দ্য ডেইলি স্টারের নয়াদিল্লি সংবাদদাতা জানান, ভারত ২০১৫ সালে সীমিত পরিসরে ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস (আইএএস) ও আমলাতন্ত্রের অন্যান্য স্তরে ল্যাটারাল এন্ট্রি চালু করেছিল। তবে প্রতি বছর কতজনকে এভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়, তার বছরওয়ারী পরিসংখ্যান জানা যায়নি।
মন্তব্য
আপনার মতামত দিন
সাম্প্রতিক মন্তব্য
সাকিব আহমেদ
২ দিন আগেখুব গুরুত্বপূর্ণ একটি খবর। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির সঠিক প্রতিফলন দেখা গেছে। ধন্যবাদ!