জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য জনগণের সম্মতি নিশ্চিত করতে গণভোট আয়োজনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে।
তবে গণভোটের সময়সূচি নিয়ে এখনো মতভেদ রয়েছে।
বিএনপিসহ কয়েকটি দল চায় জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোট অনুষ্ঠিত হোক, অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী চায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই গণভোট হোক, যেন পরবর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগেই সনদটি বাস্তবায়ন করা যায়।
এনসিপি এখনো পরিষ্কারভাবে জানায়নি— তারা নির্বাচনের আগেই নাকি নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজন করতে চায়।
গণভোট যদি নির্বাচনের দিন অনুষ্ঠিত হয়, ভোটাররা আলাদা ব্যালটপেপারে 'হ্যাঁ' বা 'না' ভোট দিয়ে জানাবেন তারা সনদটির সমর্থন করেন কি না। এরপর যে দল পরবর্তী সংসদ গঠন করবে, সেটি সনদ বাস্তবায়ন করবে। এমনটি জানিয়েছেন কমিশনের সদস্যরা।
গতকাল রোববার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটি বৈঠকের পর আলী রীয়াজ বলেন, 'জনগণের সম্মতি নেওয়ার জন্য গণভোট আয়োজনের বিষয়ে সব রাজনৈতিক দল ঐকমত্যে পৌঁছেছে। আমরা এটিকে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার প্রথম বড় ধাপ হিসেবে দেখছি।'
তিনি আশা প্রকাশ করেন, অন্যান্য বিষয় নিয়েও দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাবে। তিনি আরও জানান, কমিশন শিগগির সনদ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছে নির্দিষ্ট সুপারিশ পাঠাবে।
রীয়াজ আরও বলেন, 'ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর গঠিত সংসদ এমনভাবে সংস্কার আনার চেষ্টা করবে যেন তা দীর্ঘমেয়াদিভাবে কার্যকর ও টেকসই হয়। এ বিষয়েও কার্যত রাজনৈতিক দলগুলো একমত।'
সনদটিতে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবনা রয়েছে। এর অর্ধেকের জন্য সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন এবং বাকি অর্ধেক বিদ্যমান আইন বা সরকারি আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য।
সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে কীভাবে এগোতে হবে, গতকালের অগ্রগতি অর্জনের আগে তা নিয়ে আলোচনা স্থবির ছিল। ১১, ১৪ ও ১৭ সেপ্টেম্বরের বৈঠকের পর রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার জন্য কিছু সময় দেওয়া হয়েছিল।
এর আগে, অচলাবস্থা কাটাতে সংবিধানিক আদেশ জারি এবং সেই আদেশের ওপর সাধারণ নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে গণভোট আয়োজন করার প্রস্তাব দিয়েছিল কমিশন।
তখন বিএনপি প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছিল। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী প্রস্তাবটি সমর্থন করেছিল, তবে তারা গণভোট নির্বাচনের আগে আয়োজন করার দাবি জানিয়েছিল। জাতীয় নাগরিক পার্টি তখন বলেছিল তারা আইনি পরামর্শ নেবে।
কমিশন আগামী বুধবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরবর্তী বৈঠক করবে এবং এর মধ্যে আইনি ও সংবিধানগত বিষয়গুলো নির্ধারণের জন্য বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে পরামর্শ করবে। কমিশন ১৫ অক্টোবরের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে চায়।
সময় নির্ধারণ
বিএনপিসহ অনেক দল এখন একমত, গণভোট জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে সমন্বয় করে আয়োজন করা উচিত, তবে জামায়াতে ইসলামী চায় এটি নির্বাচনের সময় ঘোষণা হওয়ার আগে অনুষ্ঠিত হোক।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, 'সনদটির সত্যিকারের জনসমর্থন আছে কি না, গণভোট তা নিশ্চিত করবে।'
তিনি বলেন, 'আমরা সব রাজনৈতিক দল মিলে সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করি কি না, এটা একটা প্রশ্ন। আমরা রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই জাতীয় সনদে সই করেছি, অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছি— জনগণ তার পক্ষে আছে কি না, তখনই হবে জনগণের পক্ষ থেকে এই জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য একটা চূড়ান্ত অভিমত।'
বিএনপির এই নেতা স্পষ্ট করেন, গণভোট আয়োজনের জন্য কোনো সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, 'রেফারেন্ডামের (গণভোট) যে আর্টিকেল ১৪২ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার উড়িয়ে দিয়েছিল, সেটা হাইকোর্টের রায়ের মধ্য দিয়ে রিইনস্টেট (পুনঃপ্রতিষ্ঠিত) হয়েছে। এখন সংবিধানের আর কোথাও রেফারেন্ডাম করা যাবে না, এমন কোনো বিধান নেই। সুতরাং একটা অর্ডিন্যান্স জারি করে নির্বাচন কমিশনকে এখতিয়ার দেওয়া যেতে পারে একই দিনে সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি আলাদা ব্যালটে রেফারেন্ডাম (গণভোট) করার জন্য।'
সাংবাদিকেরা তার কাছে জানতে চান, যদি আগামী সংসদে জুলাই সনদের বিরোধী এমপিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হন, তবে কি তারা গণরায় মানতে বাধ্য থাকবেন? জবাবে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, 'জনরায় হচ্ছে চূড়ান্ত। যখন মানুষ হ্যাঁ বলবে সংসদ ও সংসদ সদস্যরা সেটা মানতে বাধ্য।'
জুলাই সনদের বিভিন্ন ধারার ওপর 'নোট অব ডিসেন্ট' নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'জুলাই সনদ প্রণীত হবে, স্বাক্ষরিত হবে। অঙ্গীকারনামায় সবাই সই করবেন… ওয়েবসাইটে যাবে, সব পার্টির ইশতেহারে থাকবে।'
প্রাথমিকভাবে বিএনপি জোর দিয়ে দিয়েছিল, সংবিধান সংশোধন শুধুমাত্র পরবর্তী সংসদের মাধ্যমে করা যেতে পারে। অন্য কোনো পথে সম্ভব কি না, তা জানার জন্য দলটি সর্বোচ্চ আদালতের মতামত নেওয়ার পক্ষে ছিল।
জামায়াত জানিয়েছে, গণভোট নির্বাচন হওয়ার আগে, সম্ভব হলে নভেম্বর বা ডিসেম্বর মাসে আয়োজন করা উচিত, যেন সনদটিকে 'জোরালো বৈধতা' দেওয়া যায়।
জামায়তের সহ-সাধারণ সম্পাদক হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, তার দল 'ফল যাই হোক না কেন, জনগণের রায় মেনে নেবে।'
এনসিপি এখনও স্পষ্ট করেনি তারা গণভোট নির্বাচনের আগে, নাকি নির্বাচনের দিনে আয়োজন করতে চায়। দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, 'প্রায় সব রাজনৈতিক দলই একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে— জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি আগে নিশ্চিত করতে হবে।'
তিনি পুনর্ব্যক্ত করেন, পরবর্তী সংসদকে দ্বৈত ভূমিকা পালন করতে হবে— আইনপ্রণয়ন ও সংবিধান সংশোধন দুই ক্ষেত্রেই। প্রধানমন্ত্রীর দুই মেয়াদে সীমাবদ্ধতা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন কিংবা হাইকোর্ট বিভাগকে বিকেন্দ্রীকরণের মতো বিষয়গুলো শুধু সংবিধানে সংশোধন এনে সম্ভব নয়।
মন্তব্য
আপনার মতামত দিন
সাম্প্রতিক মন্তব্য
সাকিব আহমেদ
২ দিন আগেখুব গুরুত্বপূর্ণ একটি খবর। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির সঠিক প্রতিফলন দেখা গেছে। ধন্যবাদ!